শবে বরাত: প্রচলিত ভুল ধারণা ও ইসলামি ব্যাখ্যা

- আপডেট সময় : ০১:৩০:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১০০৩৮ বার পড়া হয়েছে
শবে বরাত: প্রচলিত ভুল ধারণা ও ইসলামি ব্যাখ্যা
শবে বরাত ইসলামি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত হলেও এ নিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার ও ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অনেক মুসলিম অজ্ঞতাবশত এমন কিছু কাজ করেন যা শরিয়তসম্মত নয়, আবার কিছু ফজিলতপূর্ণ আমলকে উপেক্ষা করেন ভ্রান্ত ধারণার কারণে। এই লেখায় শবে বরাত সংক্রান্ত প্রচলিত ১০টি ভুল ধারণা ও তার ইসলামি ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
১. “শবে বরাতের রাতে জাগ্রত থাকা ফরজ”
ভুল ধারণা: অনেকেই মনে করেন, এই রাতের পুরোটা জাগ্রত থেকে ইবাদত করা বাধ্যতামূলক। না করলে গুনাহগার হবেন।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- রাসুল (সা.) শবে বরাতে ইবাদত করতেন, তবে কখনো সারা রাত জেগে ইবাদতের নির্দেশ দেননি। তিনি বলেছেন,
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে শবে কদরে ইবাদত করে, তার গুনাহ মাফ হয়।” (বুখারি: ১৯০১)।
- শবে বরাতের ব্যাপারে এ ধরনের সরাসরি হাদিস নেই। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী ইবাদত করা সুন্নত, কিন্তু জাগরণকে ফরজ মনে করা বিদআত।
২. “বিশেষ নামাজের সংখ্যা ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট”
ভুল ধারণা: ১০০ রাকাত নামাজ, ১২ রাকাত নামাজসহ নানা রকম সংখ্যাভিত্তিক নফল নামাজের প্রচলন রয়েছে।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- কোনো সহিহ হাদিসে শবে বরাতের জন্য নির্দিষ্ট রাকাতের নামাজ বর্ণিত হয়নি। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন,
“এই রাতের জন্য বিশেষ নামাজের পদ্ধতি রাসুল (সা.) বা সাহাবাদের থেকে প্রমাণিত নয়।” (মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৩/১৩২)।
- তাই যেকোনো নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ) ইচ্ছা মতো আদায় করা যায়, তবে সংখ্যা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. “আতশবাজি ফোটানো বা আলোকসজ্জা করা সুন্নত”
ভুল ধারণা: কিছু অঞ্চলে এই রাতে আতশবাজি, মোমবাতি জ্বালানো বা বাড়ি সাজানোকে ইবাদতের অংশ মনে করা হয়।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- ইসলামে কোনো উৎসব বা ইবাদতে বাহ্যিক জাঁকজমকের স্থান নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনে নতুন কিছু সংযোজন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারি: ২৬৯৭)।
- আতশবাজি ফোটানো অর্থের অপচয় এবং পরিবেশ দূষণের কারণ, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
৪. “হালুয়া-রুটি বিতরণ না করলে সওয়াব নেই”
ভুল ধারণা: অনেকেই বিশ্বাস করেন, শবে বরাতের সওয়াব পেতে হালুয়া-রুটি বিতরণ অপরিহার্য।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- হালুয়া-রুটি বিতরণ স্থানীয় সংস্কৃতি মাত্র, এর ধর্মীয় ভিত্তি নেই। ইসলামে সদকা-খয়রাতের সর্বোচ্চ গুরুত্ব রয়েছে, তবে তা নির্দিষ্ট খাবারের সাথে সীমাবদ্ধ নয়।
- ইবনে উসাইমিন (রহ.) বলেন,
“যদি কেউ নিয়ত করে যে ‘আমি শবে বরাতের সওয়াবের জন্য হালুয়া বানাব’, তবে এটি বিদআত।” (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম: ৩০৭)।
৫. “শবে বরাতেই ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়, তাই দোয়া বৃথা”
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, এই রাতে তাকদির লিখে দেওয়ায় পরবর্তীতে দোয়া বা প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসে না।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- কুরআনে বলা হয়েছে,
“আল্লাহ যা মুছে দেন বা স্থির রাখেন, তার জন্য可比 কোনো সংশোধনকারী নেই।” (সুরা রাদ: ৩৯)।
- তবে হাদিসে এসেছে, দোয়া তাকদির পরিবর্তন করে (তিরমিজি: ২১৩৯)। তাই এই রাতের তাকদির লিখন দোয়া ও প্রচেষ্টার বিপরীত নয় বরং সমন্বিত।
৬. “কবর জিয়ারত করা ফরজ”
ভুল ধারণা: অনেক পরিবারে নারী-পুরুষ সবাই কবরস্থানে যাওয়াকে বাধ্যতামূলক মনে করেন।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- রাসুল (সা.) শাবান মাসে কবর জিয়ারত করতেন, তবে তিনি নারীদের কবর যেতে নিষেধ করেছেন (তিরমিজি: ১০৫৬)।
- কবর জিয়ারতের মূল উদ্দেশ্য হলো মৃত্যুকে স্মরণ করা, কিন্তু এটিকে ফরজ বা বিশেষ ইবাদত ভাবা ঠিক নয়।
৭. “শুধু এই রাতেই গুনাহ মাফ হয়”
ভুল ধারণা: কিছু মানুষ শবে বরাত ছাড়া অন্য সময় তওবা করলে ক্ষমা পাওয়া যাবে না বলে বিশ্বাস করেন।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- আল্লাহ তাআলা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা দিন-রাতের যেকোনো সময় তওবা কবুল করেন।” (সুরা নিসা: ১১০)।
- শবে বরাত গুনাহ মাফের একটি বিশেষ সুযোগ, কিন্তু একমাত্র সময় নয়।
৮. “পরিবারের সবার জন্য আলাদা মোমবাতি জ্বালানো”
ভুল ধারণা: মৃত আত্মীয়ের রুহের মাগফিরাতের জন্য বাড়িতে মোমবাতি জ্বালানোর রীতি রয়েছে কিছু সমাজে।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- ইসলামে মৃতের জন্য দোয়া, সদকা ও হজ-ওমরা আদায় করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু মোমবাতি জ্বালানো বা আলোকসজ্জার কোনো ভিত্তি নেই।
- ইমাম মালিক (রহ.) বলেন,
“মৃতের সাথে জীবদের আচরণ ভিন্ন। মৃতের উপকার হয় দোয়া ও সদকায়, না যে কর্মে তাদের জীবৎকালে অংশগ্রহণ ছিল না।” (মুয়াত্তা মালিক: ৫৬৯)।
৯. “শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ খাবার প্রস্তুত করা জরুরি”
ভুল ধারণা: অনেকেই মনে করেন, এই রাতে বিশেষ পিঠা-পুলি বা মিষ্টান্ন তৈরি না করলে ইবাদত পূর্ণ হয় না।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ছাড়া অন্য কোনো দিনের জন্য বিশেষ খাবারের বিধান নেই। রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ খাবার তৈরি করতেন না।
- খাবার তৈরি করলেও তা নিয়ত হতে হবে আত্মীয়-স্বজনকে খুশি করা বা দান করার, না যে এটি ইবাদতের অংশ।
১০. “এই রাতে জিন-ভূতের উপদ্রব বেড়ে যায়”
ভুল ধারণা: কিছু মানুষ ভয় দেখান যে শবে বরাতে জিনেরা বের হয়, তাই বাড়িতে তালা দিতে হয়।
ইসলামি ব্যাখ্যা:
- ইসলামে জিনের অস্তিত্ব স্বীকৃত, তবে তাদের ভয় দেখিয়ে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো শয়তানের চক্রান্ত। রাসুল (সা.) বলেছেন,
“শবে বরাতে আল্লাহর রহমতের দরজা খোলা হয়, তাই এ রাত ভয়ের নয়, আশার।” (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৯)।
- আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ইবাদত করুন, অন্ধকারে লুকানো ভুল ধারণা ত্যাগ করুন।
উপসংহার
শবে বরাতের সঠিক আমল হলো তওবা, ইস্তিগফার ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। এই রাতের সাথে জড়িত কুসংস্কার ও ভুল আচরণ বর্জন করে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আমল করুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, নিশ্চয়ই আমি নিকটে। আমি ডাকার ডাকেই সাড়া দেই…” (সুরা বাকারা: ১৮৬)।
দোয়া:
“হে আল্লাহ! আমাদের শবে বরাতের সকল ভুল ধারণা থেকে মুক্তি দিন এবং এই রাতের প্রকৃত ফজিলত অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।”
পরামর্শ: এই রাতকে কেন্দ্র করে সামাজিক চাপ বা অহেতুক ব্যয় এড়িয়ে সহজ-সরলভাবে ইবাদত করুন। নিয়ত পরিশুদ্ধ করুন এবং বিদআত থেকে দূরে থাকুন।